বাংলাদেশসহ বিশ্বের প্রতিটি স্থান এখন নানা রকম পরিবেশগত সমস্যায় জর্জরিত। তোমরা কি এরকম সমস্যাগুলো অনুধাবন করতে পারছ? নানা রকম পরিবেশগত সমস্যার মধ্যে অন্যতম হলো জনসংখ্যা বৃদ্ধি (Population Growth)। এটি একদিকে যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা আবার অনেক পরিবেশগত সমস্যার মূল কারণও এটি। তোমরা কি জান, বর্তমানে সারা বিশ্বে জনসংখ্যা কত? প্ৰায় সাত বিলিয়ন। বর্তমানে যে হারে জনসংখ্যা বাড়ছে তাতে করে আগামী ২০৫০ সালের মধ্যে বিশ্বের জনসংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ১০ বিলিয়ন। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৫০ সালের পর থেকে শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ বনভূমি উজাড় হয়ে গেছে। সাথে সাথে হাজার হাজার বনজ গাছপালা এবং জীবজন্তুর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে খোদ বাংলাদেশেই হাজার হাজার একর আবাদি জমি নষ্ট হচ্ছে। এটিই স্বাভাবিক, কারণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ইত্যাদি সব রকমের চাহিদা বেড়ে যায় এবং কর্মসংস্থানের উপর চাপ সৃষ্টি হয়। কর্মসংস্থানের চাপ সামলানোর জন্য নতুন নতুন শিল্প-কারখানা তৈরি করতে গিয়ে আবাদি জমি এবং বনভূমি পর্যন্ত উজাড় হয়ে যাচ্ছে। বিপুল জনসংখ্যার জন্য চাহিদার ব্যাপক বৃদ্ধি পাওয়ায় আজ নদ-নদীতে মাছের যেন রীতিমত আকাল পড়ে গেছে। বাংলাদেশ মাছ চাষে পৃথিবীর চতুর্থতম দেশ এবং “মাছে ভাতে বাঙালি” এই কথাটি ধরে রাখার জন্যে প্রাকৃতিক মাছের উপর ভরসা না করে এখন চাষ করা মাছের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশে উৎপাদিত মোট খাদ্যশস্যের পরিমাণ ছিল প্রায় ১৯.৩২ মিলিয়ন মেট্রিক টন, যা ২০০৭-২০০৮ সালে দাঁড়ায় প্রায় ৩০ মিলিয়ন মেট্রিক টন এবং ২০১০-১১ সালে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ মিলিয়ন মেট্রিক টন। প্রায় ২০ বছর সময়ের ব্যবধানে খাদ্যশস্য উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণ হয়ে বাংলাদেশ আজ খাদ্যশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।
কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাঝে মাঝেই ফসল নষ্ট হওয়ার কারণে খাদ্যশস্য আমদানি করতে হয়। তোমরা কি জান, ১৯৯১-৯২ সালে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা কত ছিল? বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যা ছিল প্রায় ১০ কোটির মতো, যেটি এখন প্রায় ১৬ কোটি। আমাদের এই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যদি কম হতো তাহলে আজ বাংলাদেশে খাদ্যশস্য অনেক বেশি উদ্বৃত্ত থাকত, সেগুলো রফতানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করা যেত যা দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের কাজে ব্যবহার করা যেত। কাজেই জনসংখ্যার এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের সকলকে সচেতন হতে হবে এবং অন্যদেরকেও সচেতন করতে হবে।এখন প্রশ্ন হলো, জনসংখ্যা কেন এভাবে বৃদ্ধি পায়? তোমরা জান যে একটি এলাকায় একদিকে যেমন শিশুর জন্ম হয়, অন্যদিকে তেমনি নানা বয়সের লোক মৃত্যুবরণ করে। কোনো এলাকায় শিশু জন্মহার এবং মৃত্যুহার সমান হলে ঐ এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে না। কিন্তু একটি এলাকায় যে কয়জন লোক মৃত্যুবরণ করে, তার চেয়ে শিশুর জন্মের সংখ্যা যদি বেশি হয়, তা হলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে। এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া না পাওয়া অবশ্য আরো দুটি অবস্থার ওপর নির্ভর করে আর সে দুটি হলো বহির্গমন এবং বহিরাগমন। বহির্গমনের ফলে একটি দেশের জনসংখ্যা কমে যায় আর বহিরাগমন বা বাইরে থেকে আগমনের ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়। আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণ হলো এখানে জন্মহার মৃত্যুহারের চেয়ে অনেক বেশি।
আরেকটি পরিবেশগত পুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হলো নগরায়ণ (Urbanization)। এটিও আসলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সম্পৃক্ত। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে কর্মসংস্থানের জন্য গ্রামীণ জনসংখ্যার বড় একটি অংশ শহরমুখী হয়ে পড়েছে। একই সাথে শহরাঞ্চলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার যে খুব একটা কম তাও নয়। গ্রামীণ জনপদের শহরমুখিতা এবং শহরাঞ্চলের জনসংখ্যা বৃদ্ধির জন্য শহর এলাকায় আবাসন-সংকট প্রকট আকার ধারণ করেছে এবং এর ফলে আশপাশের আবাদি জমি ধ্বংস করে বা জলাভূমি ভরাট করে নগরায়ণ করা হচ্ছে। নতুন নগরায়ণের বেলায় প্রায় সময়েই ভালো বর্ণ ব্যবস্থাপনা, পানি সরবরাহসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধা না থাকায় জীবনযাপনে নানারকম সমস্যা তৈরি হচ্ছে।
এর আগের শ্রেণিতে তোমরা বৈশ্বিক উষ্ণতা কী তা জেনেছ। এর মূল কারণ হলো কার্বন ডাই- অক্সাইডসহ ওজোন, মিথেন, সিএফসি, নাইট্রাস অক্সাইড এবং জলীয় বাষ্প, যেগুলো গ্রিন হাউস গ্যাস নামে পরিচিত, সেগুলোর পরিমাণ বেড়ে যাওয়া। গ্রিন হাউস গ্যাসগুলো বাড়ার কারণ কী? এই গ্যাসগুলোর মূল উৎস হলো যানবাহন, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র ইত্যাদি থেকে সৃষ্ট ধোঁয়া,রেফ্রিজারেটর কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে ব্যবহৃত প্যাস। এছাড়া কিছু কিছু প্রাকৃতিক কারণ (যেমন : আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, দাবানল, গবাদিপশুর মলমূত্র, প্রাকৃতিকভাবে গাছপালার ক্ষয়) ইত্যাদি দায়ী । জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে যানবাহন, শিল্প-কারখানা, বিদ্যুতের চাহিদা বেড়ে যাচ্ছে, ফলে গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণও বেড়ে যাচ্ছে। আবার জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বনভূমি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে প্রাকৃতিক উপায়ে গাছপালার যারা কার্বন ডাই-অক্সাইডের শোষণ কমে যাচ্ছে, যার ফলে বায়ুমণ্ডলে এর পরিমাণ ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণ এই গ্রিন হাউস গ্যাসের নিঃসরণ না কমালে, বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ধীরে ধীরে বেড়ে যাবে (চিত্র ৯.০২) যার ফলে জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ঘটবে। জলবায়ুজনিত পরিবর্তন ঘটলে পরিবেশে কী ধরনের বিরূপ প্রভাব পড়বে, সেটি তোমরা এই অধ্যায়ের শুরুতেই জেনেছ।
বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বেড়ে যাওয়াকেই কার্বন দূষণ বলে। বাতাসে কার্বন ডাই- অক্সাইডের পরিমাণ কেন বেড়ে যায় সেটা তোমরা আগের পাঠে জেনেছ।
বনশূন্য করা একটি মারাত্মক পরিবেশগত সমস্যা। তোমরা ইতোমধ্যেই জেনেছ যে বনশূন্য করা বা বনভূমির উজাড় হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে জনংখ্যা বৃদ্ধি। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে ঘর-বাড়ি, রাস্তাঘাট, অন্ন, বস্ত্র ইত্যাদি সব রকম চাহিদা বৃদ্ধি পায়। আর প্রতিটি চাহিদাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বনশূন্য করার সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
আরও দেখুন...